ভূমিকা : মানুষ তার জীবিকার অন্বেষায় এবং অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে। | প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত। মানুষের এ সগ্রামের নাম জীবনসগ্রাম; আর | এ সংগ্রামের সবচেয়ে বড় পুঁজি বা মূলধন হলাে শ্রম। মানুষ মেধা, শক্তি | ও শ্রম দিয়ে তার অভাব বা প্রয়ােজন পূরণ করে। শ্রমের মাধ্যমে মানুষ | তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন | ঘটায়। এজন্য বলা হয় ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
শ্রম কী : শ্রম হচ্ছে কায়িক, মানসিক বা উভয়ের সমন্বিত এমন শক্তি, | যা দ্বারা নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের ফলে মানুষ তার কাঙিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করে। মানবজীবনের উন্নতি, অবনতি, সমাজ সভ্যতা বা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, উন্নতি ও বিকাশ পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। পরিশ্রমের মাধ্যমে ব্যক্তি বা জাতি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরােহণ করতে পারে। আবার পরিশ্রমবিমুখ হলে ব্যক্তি বা জাতির পতন অনিবার্য। শ্রমের শ্রেণিবিভাগ : সব ধরনের শ্রমকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : ১. দৈহিক শ্রম ও ২. মানসিক শ্রম। শারীরিক বা পেশিশক্তি প্রয়ােগ করে যে শ্রম দেয়া হয় তাই দৈহিক বা কায়িক শ্রম। রিকশাচালক, ঠেলাগাড়ি চালক, কৃষক এ শ্রেণির শ্রমে অভ্যস্ত। আর মানসিক শ্রম হলাে প্রতিভা বা জ্ঞান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে শ্রম দেয়া হয়। ডাক্তার, শিক্ষক, উকিল প্রভৃতি পেশার মানুষ এ শ্রেণির শ্রম দেয়। কায়িক ও মানসিক শ্রম ছাড়া এ দুয়ের সমন্বয়ে কিছু মানুষকে শ্রম দিতে দেখা যায়। তবে যে প্রকারের শ্রম হােক না কেন মানবজীবনে উন্নতি ও সাফল্য লাভের জন্য সব ধরনের শ্রম অপরিহার্য। পরিশ্রম দ্বারা সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব।
শ্রমের গুরুত্ব/প্রয়ােজনীয়তা : মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় জীবনে শ্রমকে ডিঙিয়ে উন্নতি বা অগ্রগতির আশা করা যায় না। ব্যক্তিজীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, উন্নতি, অগ্রগতি, অর্থ, সাফল্য লাভের জন্য সব ধরনের শ্রম অপরিহার্য। পরিশ্রম দ্বারা সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব। পরিশ্রম ছাড়া তৃণখন্ডটিও অর্জন করা সম্ভব হয় না। প্রভাব প্রতিপত্তি, আত্মপ্রতিষ্ঠা সবকিছুই পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য পরিশ্রমবিমুখ মানুষ জীবনে উন্নতি করতে পারে না। পরিশ্রমবিমুখ জীবন আনন্দহীন, গতিহীন এবং একঘেয়ে। শ্রমহীন জীবন বােঝাস্বরূপ। জীবনকে চঞ্চল ও অর্থবহ করে তুলতে শ্রমের বিকল্প নেই। পৃথিবীতে যত বড় বড় কাজ সাধিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে পরিশ্রম। পৃথিবীতে যারাই বা যে দেশ উন্নতি লাভ করেছে, পরিশ্রমের জোরে করেছে। যে জাতি যত পরিশ্রমী সে জাতি তত উন্নত, সমৃদ্ধশালী। তাই ব্যক্তি, সমাজ, জাতি বা রাষ্ট্র কোনাে ক্ষেত্রে শ্রমের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।
শ্রম সম্পর্কে আমাদের ধারণা : আমাদের দেশে শ্রমকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। বরং শ্রমকে ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। বিশেষ করে কায়িক শ্রমকে আমরা অমর্যাদাকর ও মানহানিকর মনে করি। কায়িক শ্রম যে অমর্যাদাকর নয় বা কোনাে কাজ যে ক্ষুদ্র নয়- এ সত্যটি আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ শ্রমের মর্যাদা বিদেশিরা যথার্থরূপে জানে ও বােঝে। এজন্য মুচি, মেথর, কুমার, কামার, কৃষক কারাে কাজকে তারা ছােট করে দেখে না। তারা নিজের কাজ নিজে করতে স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে। তাদের কাছে কাজের ছােট বড় মানদণ্ড নেই। আর এ কারণে তারা প্রভূত উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করেছে।
শ্রমজীবী কতিপয় মনীষীর দৃষ্টান্ত : বিশ্বের সব বিখ্যাত ব্যক্তি ও মহামনীষীর জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তারা সবাই পরিশ্রমী ছিলেন। শুধু মেধার জোরে কেউ বিখ্যাত হননি বা মনীষী খেতাব পাননি। পরিশ্রমের কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনাে দুপুরে ঘুমানাের অবসর পাননি; নজরুল ইসলাম রুটির দোকানে কাজ করেছেন। পরিশ্রমী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ও ওয়াশিংটন জগৎখ্যাত। পরিশ্রম করতে গিয়ে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন সাদাসিধে জীবনযাপন করেছেন এবং নিজের কাজ নিজে করেছেন। আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন আরাে কঠোর পরিশ্রমী। তার জীবদ্দশায় গৃহস্থালির ক্ষুদ্র কাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত কোনাে কাজ করতে বাদ রাখেননি। তিনি কাজকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ও স্থান দিয়ে বলেছেন, “নিজ হাতে কাজ করার মতাে পবিত্র জিনিস আর নেই।” তিনি আরাে বলেছেন, “নিজ পরিশ্রমে উপার্জিত রুজি সর্বোত্তম।”
শ্রমের মর্যাদা : মানবজীবন শ্রমের মর্যাদার স্মারক। মানুষের পরিশ্রম বা কর্মকাণ্ডই মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট করে দেয় তার স্থান, মর্যাদা ও ক্ষমতা। পরিশ্রমের জোরে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হাসি হাসে, আবার পরিশ্রম না করার কারণে মানুষ হয় ভাগ্য বিড়ম্বিত। পরিশ্রমের কারণে। মানুষ মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠে; আবার পরিশ্রম না করার ফলে হয় লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। জনৈক মনীষী এমবিমুখ মানুষকে ‘চোর’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, “যে পরিশ্রম না করে খায়, সে চুরি করে খায়। প্রতিটি মানুষের জীবনে মর্যাদার প্রশ্নে পরিশ্রমের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মে শ্রমের ওপর সবিশেষ পুৱত দিয়েছে। প্রতিটি ধর্ম ও সব মনীষী শ্রম ও শ্রমিকের বিশেষ মর্যাদা, দিয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, “শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানাের আগেই। তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”
উপসংহার : পরিশ্রম মানুষের উন্নতি ও মর্যাদার মাপকাঠি। কায়িক বা মানসিক কোনাে কাজই ক্ষুদ্র নয়। সুত্র কাজ বলে অবহেলার মানসিকতা দূর করা উচিত। কেউ ক্ষুদ্র কাজ বা কায়িক শ্রম দিলেই যে সে স্কুল এ | ধারণা সবার পরিহার করা শ্রেয়। রং তারাই দেশ ও জাতির বৃহৎ মঙ্কাল | সাধনায় লিপ্ত ও ব্যাপৃত। শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন এবং সব ধরনের কাজে আশাচিত্তে সবার আত্মনিয়ােগের মধ্যে দেশ ও জাতি তথা সন্ত্র মানবসভ্যতার মাল ও কল্যাণ নিহিত।