ভূমিকা : পৃথিবীকে আজ আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। জীবন এবং আজকের সভ্যতার এমন কোনাে অধ্যায় নেই যেখানে বিজ্ঞানের প্রয়োেগ ঘটেনি। বিজ্ঞান জীবনকে করেছে গতিশীল, সুন্দর, | স্বাচ্ছন্দ্যময়। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে, প্রকৃতির | বিপুল সম্পদে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন | আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে উন্নতির নব নব স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের কল্যাণকর শক্তি মানুষকে পশুস্তর থেকে উন্নীত করে পরিণত করে সভ্য মানুষে। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি সাধনের জন্য কৃষিকাজে বিজ্ঞানের | প্রয়ােগের অপরিহার্যতা সম্পর্কে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের অবদান : মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়ােগে যে অগ্রগতি ও উন্নতি সাধিত হচ্ছে কৃষির বিষয়টি তার ব্যতিক্রম – নয়। বিশ্বে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পরিপ্রেক্ষিতে সচেতন মানবসমাজ | উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানের সহায়তায় কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন | করেছে। উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের জন্য প্রচুর গবেষণার কাজ চলছে। ব্যাপক জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের | বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন : চাষকাজের সুবিধার জন্য কলের লাঙল, পানি সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ, বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রক্ষা করে প্রয়ােজনমতাে ব্যবহার, পােকামাকড়ের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য কীটনাশক ইত্যাদি। এছাড়া গবেষণার মাধ্যমে ভালাে জাতের ফসলের উদ্ভাবন, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নতমানের সারের উদ্ভাবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে | বিজ্ঞান বিশেষ অবদান রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাদ্য সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যার ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনই একটি গবেষণার কেন্দ্র আইআরআরআই (IRRI) ধানের উচ্চ ফলনের জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান : উন্নত দেশসমূহে আজ কৃষিকাজ | সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। জমি কর্ষণ, বীজ বপন, সেচ কাজ, ফসল কাটা, মাড়াই এবং বাছাই ইত্যাদি সব কাজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয়। ট্রাক্টরের সাহায্যে জমি চাষ করে মেশিন দিয়ে জমিতে বীজ বপন করা হয়। তার আগে বপনের জন্য সংরক্ষিত বীজ বাছাই কাজও যন্ত্র দ্বারা করা হয়। জমিতে প্রয়ােজনমতাে সার দেয়া। কিবা ফসলে পােকা লাগলে তা দমনের জন্য ওষুধ ছিটানাের কাজও যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়। আজকের যুগে ফসলের জমি সেচের জন্য মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টি শস্য জন্মানাের অন্তরায় হয় না। আজ মানুষ গভীর নলকূপ এবং পাম্পের সাহায্যে জমিতে সেচ দেয়। ফসল কাটা যন্ত্রের সাহায্যে একদিকে ফসল কাটছে, অন্যদিকে যন্ত্রের সাহায্যে মাড়াই হয়ে শস্য ও খড় আলাদা হয়ে যাচ্ছে। শীতপ্রধান দেশে শীত নিয়ন্ত্রিত ঘর বানিয়ে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপন্ন করছে। বিজ্ঞানের সাহায্যে বর্তমানে মরুভূমির মতাে জায়গায় সেচ, সার ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করে সােনার ফসল ফলাচ্ছে।
বালাদেশের কৃষিব্যবস্থা : আধুনিক কৃষিতে বিজ্ঞানের কিছু প্রভাব পড়লেও এ দেশের কৃষিব্যবস্থা এখনাে মান্ধাতার আমলের। একজন জীর্ণ কৃষক ততােধিক জীর্ণ দুটি বলদকে ঠেলে কৃষি উৎপাদনের ব্যর্থ -প্রচেষ্টা চালায়। উন্নত কৃষি প্রয়ােগের প্রয়ােজনীয় জ্ঞান তাদের যেমন নেই, তেমনই উন্নত কলাকৌশল প্রয়ােগের ও আর্থিক সামর্থ্যের দারুণ অভাব। ফলে জমি থেকে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয় তা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত এবং কৃষকের জীবনে সচ্ছলতা আনয়ন করতে পারে না। সামগ্রিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দেশের চাহিদা মেটানাের মতাে খাদ্যশস্য জমি থেকে উৎপাদিত হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এদেশে অশিক্ষা আর দারিদ্র্যের কারণে কৃষিকাজে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানল কলাকৌশল প্রবর্তন করা পরিপূর্ণরূপে সম্ভব না হওয়ায় খাদ্য। সমস্যা সমাধানও সম্ভব হচ্ছে না। তাই, এদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশের কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রভাব : স্বল্প পরিমাণে হলেও আমাদের দেশে এখন কৃষিকাজে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশেও উৎপাদন কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য জমির খন্ড-বিখণ্ডতার কারণে ব্যাপকভাবে ট্রাক্টর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। | সেচকাজের জন্য মানুষ এখন আর চাতক পাখির মতাে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। এখন সেচ কাজে ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপ | এবং মেশিনচালিত পাম্প। উপযুক্ত না হলেও কৃষকরা বর্তমানে কীটনাশক ব্যবহার করছে এবং উন্নত বীজ ব্যবহারের ব্যাপকতা | বাড়ছে। দেশে কৃষি গবেষণা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ও দ্রুত | ফলনশীল ফসলের বীজ উদ্ভাবনে সফলকাম হয়েছে। কিছুদিন আগে | একটি উন্নতমানের সার উদ্ভাবিত হয়েছে। ফলে আমাদের মতাে | উন্নয়নশীল দেশও ক্রমান্বয়ে কৃষির মাধ্যমে উন্নতির পথে ধাবিত হচ্ছে।
কৃষিতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব : আমাদের দেশে শিল্পায়ন সুদূরপরাহত। তাই জাতীয় উন্নয়ন একান্তই কৃষির মুখাপেক্ষী। কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন | আমাদেরকে পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা যায়, ১৭৪টি দেশের মধ্যে উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৬তম। সুতরাং দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের কৃষিতে বিজ্ঞানের ব্যবহার অপরিহার্য। খন্ড | খন্ড জমি একত্রিত করে ট্রাক্টরের সাহায্যে উন্নত বীজ সরবরাহ কৃষিঋণের ব্যবস্থা, পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিরক্ষরতা দূর করে কৃষকদের কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে।
উপসংহার : মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি দিন দিন বাড়ছে। প্রকৃতিকে কীভাবে আরাে ব্যাপকভাবে মানবকল্যাণে কাজে লাগানাে যায় তার জন্য ব্যাপক গবেষণা চলছে। আকাশের মেঘ নিয়ন্ত্রণে এনে কৃষি উৎপাদনের কাজে লাগানাের চেষ্টা মানুষ করছে। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের অবদান অনন্য। দেশের পঁচাশি ভাগ লােক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আধুনিক বিশ্বের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভান্ডার দিয়ে কৃষিকে উন্নতমানের করা সম্ভবপর হলে জাতির অগ্রসরতা কাটানাে সম্ভব।