ভূমিকা : বাংলাদেশে বছরে বারােটি মাস পালাক্রমে আসে যায়। এই আসা যাওয়ার পালায় বৈশাখের স্থানই সর্বাগ্রে। পুরাতন বছরের জীর্ণ খ ক্লান্ত রাত্রির আজিম প্রহর বিদায় ঘােষণা করে নব আশার প্রত্যয়ে নব সূর্য | উদিত হয় রক্তিম আভা নিয়ে। এই সূর্য বৈশাখের প্রথম দিনের সূর্য। বৈশাখের প্রথম দিনটি প্রকৃতির নিসর্গ মঞ্চে ধ্বনিত করে নবজীবনের সংগীত। এই দিনে প্রকৃতিতে আনন্দ উচ্ছাসের ঝরনাধারা বয়ে চলে। পাখির কণ্ঠে শােনা যায় নব প্রভাতের বন্দনা গীত। আর এই গীতের সুরের রেশ ধরেই দিকে দিকে মানুষের মাঝে শুরু হয় বর্ষবরণের নতুন আয়ােজন। এ আয়ােজনের প্রত্যয়দীপ্ত আহ্বান হলাে :
‘হে নতুন, এসাে তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে।
নববর্ষের বৈশিষ্ট্য : পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির জীবনে একটি গৌরবােজ্জ্বল দিন। এটি বাংলা সনের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ এখন বাঙালি ও বাংলাদেশি জাতিসত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সংস্কৃতির অঙ্গ * হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বাংলা সন শেষ হয় চৈত্র মাসের বিদায়ের মাধ্যমে। বৈশাখ এসে বছরের যাত্রা শুরু করে। নর্ষের আগমন যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং তার মধ্যে যে তাৎপর্য ও ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে আসছে তা তার সােচ্চার আগমন থেকে অনুধাবন করা যায়। মানুষ। বিগত বছরের যাবতীয় হীনতা, দীনতাকে ঝেড়ে ফেলে নব উদ্যমে। পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেয়। এ সময় প্রকৃতির নানা পরিবর্তন চোখে পড়ে, যা মানবমনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। নবজীবনের। ন্যায় সবার মাঝে অকৃত্রিম আনন্দ অনুভবের জন্ম হয়।
নববর্ষের প্রথম প্রহর : পুরাতন বছরের নানা গ্লানিময় রাতের অবসান হতে না হতেই শুভ্র-সুন্দর পােশাক পরে সব বাঙালিপ্রাণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। দলে দলে তারা নববর্ষ বরণ করতে ছুটে চলে। খুশির ফোয়ারা সাজিয়ে রমনা বটমূল সবাইকে আহ্বান করতে থাকে। নতুন বর্ষ বরণ করে নিতে ছায়ানট শিল্পীগােষ্ঠী তখন গাইতে থাকে-
“এসাে এসাে এসাে হে বৈশাখ।
তাপস নিশাসবায়ে
মুমূর্বুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক ॥”
এভাবে চলতে থাকে নানা অনুষ্ঠান। বাঙালিপ্রাণ পান্তা আর ইলিশের সানিধ্য পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চারদিকে নানাধরনের মেলা বসে। যেখানে বাঙালিপনার সব পসরা সাজিয়ে বসে থাকে দোকানিরা। পুরুষেরা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মেয়েরা বাসন্তী রং শাড়ি পরে আদটি দিকে দিকে ঘুরে বেড়ায়। ধীরে ধীরে প্রভাত দীর্ঘ হতে থাকে। মানুষেরা | আরাে ব্যস্ততায় উৎসব আমেজে জেগে ওঠে।
বৈশাখি মেলাঃ নববর্ষের প্রথম দিনেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। এজন্য একে বৈশাখি মেলা বলা হয়। এ মেলা একদিনও স্থায়ী হয় | আবার এক সপ্তাহ বা মাসব্যাপীও চলে। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে | লালিত এ মেলা সবার মাঝে প্রাণস্পর্শী আনন্দ সঞ্চার করে আজও | আবহমান বাঙ্গাজুড়ে বিরাজমান।
নর্ষে বাঙালির উৎসব-অনুষ্ঠান : নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টির সঙ্গে। নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আর এসব উৎসব-অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যগত দিকটিও বেশ সমৃদ্ধ। অনেক প্রতিষ্ঠান নববর্ষ উপলক্ষে বইমেলার আয়ােজন করে। তবে নববর্ষের প্রথম দিনে আয়ােজিত মেলা সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়। | নববর্ষের মেলা এদেশের বহু প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে বৈশাখি মেলা বসে। নানা ধরনের জিনিস বিশেষত কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর প্রচুর সমাবেশ ঘটে এসব মেলায়। দেশীয়। খাবার দাবার, হােটদের মন-ভুলানাে পণ্য, সেই সঙ্গে বিনােদনের নানা | উপকরণ মেলাকে আকর্ষণীয় করে তােলে। আনন্দ কোলাহলে মুখরিত হয় মেলা। মেলায় আসা, স্বদলবলে ঘুরে ফিরে দেখা, বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, প্রয়ােজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনাকাটা করা, দেশীয় খাবার খাওয়া, ছােট ছেলেমেয়েদের হাতে তাদের শখের জিনিস তুলে দেয়া এসবই হয়ে থাকে বৈশাখি মেলায়।
নববর্ষের তাৎপর্য : বর্ষ প্রদক্ষিণের পথে এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যে ভাস্বর। এ দিনটি প্রাত্যহিকতার জীর্ণ জীবনের গন্ডি থেকে চিত্তের দীনতা | ও হতাশা থেকে মুক্তির দিন। প্রতিদিনের জীবনে আমরা ক্ষুদ্র, কিন্তু নববর্ষের পুণ্য প্রভাতে আমরা মহৎ। এ দিন আমাদের কাছে পরম | আশ্বাসের, পরম আরাধনার। এ পুণ্য দিনে আমরা লাভ করি এক। মহাজীবনের উদার সান্নিধ্য।
উপসংহার : বাঙালি জাতির সুখ ও সমৃদ্ধির একটি বিশেষ স্থানজুড়ে | আছে নববর্ষ। আর এ নববর্ষ আসে সীমাহীন আনন্দের পসরা নিয়ে। তাই এ উৎসবের অঙ্গে যুগ-পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। নববর্ষে আমরা যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃতগৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয়। পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণী ইচ্ছার ভাবরসে।