স্বদেশের উপকারে নাই যার মন কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন। প্রতিটি মানুষই বিশ্বপ্রকৃতির সন্তান। কিন্তু জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট দেশ ও সমাজে সে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠে। এর মাধ্যমেই সে ভােগ করে স্বদেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক সুযােগসুবিধা। আর তাই জন্মগতভাবেই সেই দেশের প্রতি তার হৃদয়ে গড়ে ওঠে আন্তরিক ভালােবাসা। মানুষের মনে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এ ভালােবাসার জন্ম হয়।
স্বদেশপ্রেম কী : স্বদেশপ্রেম অর্থ হচ্ছে নিজের দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, ভাষার প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করা। দেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ, নিবিড় ভালােবাসা এবং যথার্থ আনুগত্যকে দেশপ্রেম বলে। জন্মভূমির স্বার্থে সর্বস্ব ত্যাগের সাধনাই স্বদেশপ্রেম।
দেশপ্রেমের স্বরূপ : স্বদেশের প্রতি ভালােবাসা মানুষের হৃদয়ের গভীর অনুভূতির প্রকাশ। এ ভালােবাসা মায়ের প্রতি ভালােবাসার মতােই পবিত্র। যত দারিদ্র্যপীড়িত, যত অনুনুতই হােক না কেন, দেশপ্রেমিকের কাছে তার মাতৃভূমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ। স্বদেশের জন্য সে নিজের | সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে। স্বদেশের কল্যাণে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে | * বরণ করতে পারে। স্বদেশপ্রেমে কোনাে কৃত্রিমতা বা ভণিতা থাকে না। | নিজের জীবন, ধনসম্পদ সবকিছুর চেয়ে দেশপ্রেমিকের কাছে স্বদেশপ্রিয়। এডউইন আরনল্ড দেশপ্রেমের স্বরূপ তুলে ধরেছেন এভাবে “জীবনকে ভালােবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।” এ ভালােবাসা শর্তহীন; দায়িত্ব ও কর্তব্যবােধে উজ্জীবিত; বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মহিমায় গরীয়ান।
দেশপ্রেমের প্রকাশ: নানা ভাবে দেশপ্রেমিকের দেশপ্রেম প্রকাশিত হয়। দেশের জন্য যেকোনাে ত্যাগ স্বীকারে সদাপ্রস্তুত সে। নিজের দায়িত্ব ও | কর্তব্য পালনে অগ্রসর হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে সে। স্বদেশের। | যেকোনাে গৌরবােজ্জ্বল অর্জনে গর্ববােধ করে দেশপ্রেমিক। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পালন করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের যে কোনাে দুর্দিনে সে জীবনবাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়ে। স্বদেশের সংস্কৃতির প্রতি তার থাকে অগাধ ভালােবাসা। মানুষের কল্যাণে সর্বদা | নিয়ােজিত থাকে তার সব কর্ম প্রচেষ্টা।
দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত : বিশ্বের সব মহামনীষীর জীবনই দেশপ্রেমে | উজ্জীবিত ছিল। অসংখ্য মনীষী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন স্বদেশের – জন্য। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনও স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল। | দৃষ্টান্ত। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় তিনি স্বদেশের দিকে বারবার ফিরে তাকিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “হে মক্কা আমি তােমাকে সবচেয়ে বেশি ভালােবাসি কিন্তু তােমার জনগণ আমাকে থাকতে দিল না।” এ থেকে তাঁর দেশপ্রেমের নমুনা লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য দেশপ্রেমিকের রক্তে গৌরবান্বিত হয়েছে। তার স্বদেশ। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় জীবন দিয়েছেন দেশপ্রেমিক সিরাজউদদৌলা। হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের বীর সেনানীরা। দেশমাতৃকার মুক্তিসগ্রামে জীবন দিয়েছেন তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রফুল্ল চাকি, প্রীতিলতা, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ক্ষুদিরামের মতাে দেশমাতৃকার বীর। সম্ভারা। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উৎসর্গিত হয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের মতাে আরাে অনেকে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন ত্রিশ লাখ বাঙালি। নিজ নিজ দেশকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন ইতালির গ্যারিবল্ডি, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সে তুং, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভিয়েতনামের হাে চি মিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক।
বাঙালির স্বদেশপ্রেম : পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক জন্মেছেন। তাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে অমর হয়ে আছেন। বাংলাদেশেও তার অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে | বিদেশি শক্তি প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, আর স্বদেশপ্রেমিক বাঙালি দেশের স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষার্থে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হাতে বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতের আত্মদান দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে এক | নতুন মাত্রা সংযােজন করেছে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মদান করেছে অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষিক, কৃষক-শ্রমিক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, মা-বােনসহ সাধারণ মানুষ। অকুতােভয় শত-সহস্র এ সৈনিকের দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এখনাে এদেশের লক্ষকোটি জনতা দেশের সামান্য ক্ষতির আশঙ্কায় বজ্রকণ্ঠে গর্জে ওঠে। |
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম : স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। | কেননা বিশ্বের সব মানুষই পৃথিবী নামক এই ভূখন্ডের অধিবাসী। তাই | স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে সকলেরই বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও বিশ্ব-মানবতাকে | উচ্চকিত করে তুলতে হবে। কারণ বিশ্বজননীর আঁচল-ছায়ায় দেশজননীর ঠাই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে জন্যই গেয়েছেন-
“ও আমার দেশের মাটি, তােমার `পরে ঠেকাই মাথা’
তােমাতে বিশ্বময়ীর – তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥”
উপসংহার : স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। দেশপ্রেম থেকেই বিকশিত হয় মানবপ্রেম, বিশ্বপ্রেম। প্রতিটি মানুষের উচিত ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া। এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।