আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান মানবসভ্যতার এক বিশিষ্ট অবদান। মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়। অক্সিজেন ছাড়া যেমন প্রাণিকুলের জীবনধারণের কথা কল্পনা করা যায় না, তেমনই | বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতাকেও কল্পনা করা যায় না। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসেছে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি; এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। আদিম যুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানবসভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের দান।।
জীবন ও বিজ্ঞান : জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মানুষ নিজের জীবনের প্রয়ােজনে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছে। বলা যায়, বিজ্ঞান এসেছে মানুষের জীবনের প্রাত্যহিকতার প্রয়ােজনে। মানুষ বিজ্ঞানের আবিষ্কার নিয়েই জীবনের বিচিত্র বিকাশ ঘটিয়েছে। মানুষ প্রতিনিয়ত সাধনা করে চলছে আর আবিষ্কার করছে জীবনকে সুখকর করার নানা জিনিস। এভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
বিজ্ঞানের গুরুত্ব : বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্র বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বিদ্যুৎ | মানবসভ্যতাকে অত্যধিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞান এক দেশের খবর অন্য দেশে নিমিষের মধ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। দূরত্ব কমিয়ে সারা পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। কাগজ, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষাক্ষেত্রে এনে দিয়েছে ব্যাপক প্রসারতা। পরিবহন ও যােগাযােগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এনেছে গতিময়তা। মূলত বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে, আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার সুখসমৃদ্ধি | বর্ধন। তাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বিজ্ঞানের গুরুত্ব। অপরিসীম।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশ। রেডিও, টেলিভিশন, মােবাইলফোন, সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি ও বৈদ্যুতিক হিটার ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে | আমাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজতর ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। অফিস-আদালতে নিত্য ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার, ফটোস্ট্যাট মেশিন, টেলেক্স ইত্যাদি যন্ত্রপাতি। এভাবে বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কত রকম প্রয়ােজন যে মেটাচ্ছে তার শেষ নেই। |
বৈদ্যুতিক পাখা : বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর অবদান বৈদ্যুতিক পাখা। – এটি আমাদের গ্রীষ্মের উষ্ণতায় এনে দেয় প্রশান্তি। আধুনিক জীবনে | বাসগৃহ, অফিস-আদালত প্রভৃতিকে আমাদের জন্য আরামদায়ক করে | তােলার ক্ষেত্রে এর শীতল বাতাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটি ছাড়া গ্রীষ্মের দুঃসহ গরমে আমাদের এক মুহূর্ত কাটানাে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বৈদ্যুতিক বাতি : দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বাসগৃহ, অফিস আদালত, | কলকারখানা, নগরজীবন এমনকি পল্লি জনপদকেও আলােকিত রাখার জন্য আমরা যে জিনিসটির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করি তা হচ্ছে | বৈদ্যুতিক বাতি। আর এটি হচ্ছে বিজ্ঞানের অসামান্য অবদান।
বেতার ও টেলিভিশন : বেতার ও টেলিভিশন বিজ্ঞানের দুটি বিস্ময়কর | অবদান। এগুলাের সাহায্যে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত | ঘটনাবলির খবরাখবর জানতে পারি। তাছাড়া এগুলােতে বিভিন্নশিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নাটক, গান ইত্যাদি প্রচার করা হয়, যা আমাদের জ্ঞানের বিকাশ ও চিত্তবিনােদনে সহায়তা করে।
কম্পিউটার : বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর অবদান কম্পিউটার; যা মানব মস্তিষ্কের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এটি রােগীর রােগ নির্ণয়, ব্যবসায়ের লাভ-লােকসানের হিসাব, যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, প্লেন, ও ট্রেনের আসন সংরক্ষণ এবং সাম্প্রতিক পরীক্ষার ফলাফল তৈরি ও। প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি দাবা ও ভিডিও গেম খেলতে। পারে। আজকাল আমরা অফিস-আদালত, ব্যাংক, বিমা, টেলিযােগাযােগ, গবেষণা ও পর্যালােচনা, ডাকসেবা, প্রকাশনা ইত্যাদি। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ব্যবহার করছি। এক কথায়। কম্পিউটার হচ্ছে আধুনিক সভ্যতাকে অত্যাধুনিকে রূপান্তরিত করার একটি বৈজ্ঞানিক কৌশল।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান : চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে আজ মানুষ অকাল মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা ইত্যাদি ব্যাধিতে মানুষকে আর অসময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয় না। উন্নতমানের ওষুধ, অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা, এক্সরে, আলট্রাভায়ােলেট-রে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসেছে এক আমূল পরিবর্তন।
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান : জনসংখ্যা বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা মানুষ আজ এই বিজ্ঞানের বলেই জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য আবিষ্কার করে চলেছে নানা সরঞ্জামাদি এবং নব নব পদ্ধতি।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান : আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রেও অশেষ উন্নতি সাধন করেছে। প্রাচীন ভোতা লাঙলের পরিবর্তে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নতমানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। পচা আবর্জনা ও গােবরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক রাসায়নিক সার। প্রকৃতির দয়ার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে পানি সেচের ব্যবস্থা করা। হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে উন্নতমানের বীজ। বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় আজ ধান, গমসহ মানুষের সকল প্রকার খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানের অবদানের ফলে ইতােমধ্যেই গরু, হাঁস-মুরগি, মাছসহ বিভিন্ন প্রয়ােজনীয় জিনিসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
যােগাযােগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থার পুরােটাই বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। যােগাযােগ ব্যবস্থা সহজতর ও দ্রুততম করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছে নব নব যানবাহন। দ্রুততম রেলগাড়ি, আধুনিক কনকর্ড বিমান, মাটির তলায় ধাবমান টিউবয়েল সবই বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের অবদানেই আজ আমরা এরােপ্লেনে চড়ে শূন্য আকাশে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছি, যা ছিল একসময় স্বরে ব্যাপার।
প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের কল্যাণেই মানুষ প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক দিক থেকে নিজেদেরকে রক্ষা পাবার পূর্বাভাস পেয়ে থাকে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস, নদীশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষ বিজ্ঞানের বলেই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
অপকারিতা : বিজ্ঞান একদিকে যেমন মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন। করে আসছে, অন্যদিকে তেমনই এনেছে বিভীষিকা। এটম বােমা, হাইড্রোজেন বােমা, নিউট্রন বােমা ইত্যাদি মারাত্মক মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানবসভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখােমুখি। ডিনামাইট, বােমারু বিমান, ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্মে সময় আমেরিকার বােমা বর্ষণের পর জাপানের হিরােশিমা ও নাগাসাকি শহরের ধ্বংসযজ্ঞ তারই বাস্তব প্রমাণ।
উপসংহার : মানবসভ্যতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান। | সর্বোপরি, বিজ্ঞান আমাদের সুখ-সমৃদ্ধি আনয়ন করেছে এবং আমাদের | দৈনন্দিন জীবনকে করেছে গতিময়। কিন্তু মানুষ যদি বিজ্ঞানের | কল্যাণকর শক্তিকে অপব্যবহার করে তবে দোষ বিজ্ঞানের নয়; দোষ মানুষের। মানুষ যদি বিজ্ঞানের শক্তিকে অপব্যবহার না করে শুভবুদ্ধি দ্বারা চালিত হয় এবং বিজ্ঞানকে সভ্যতার বিকাশে কাজে লাগায় তবে বিজ্ঞান অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদই হবে।