“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই – মুক্তিকামী দেশের সেযে আশা।” বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ লোেক কৃষক। প্রাচীনকাল থেকে কৃষিকে ভিত্তি করেই এদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আর কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এদেশের কৃষক। কঠোর পরিশ্রম। করে যারা জমিতে ফসল ফলায় তারাই কৃষক। তাদের উৎপাদিত | ফসলই বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করে তােলে। কৃষক আমাদের খাদ্য জোগায়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষকের ভূমিকা : বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার কৃষি। তাই বাংলার কৃষক হচ্ছে বার কৃষির প্রাণ। কৃষকের ঘাম ঝরানাে ফসলই এদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে। কৃষকের উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে দেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি গড়তে কৃষকের ভূমিকা অপরিসীম। বলা যায়, কৃষকই জাতির মেরুদন্ড।
কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণ : প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কারণ এদেশের ভৌগােলিক অবস্থান এবং জলবায়ু। নদীবিধৌত সমতল ভূমি হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের জন্য এখানকার জমি খুবই অনুকূল। তাই অতি অল্প পরিশ্রমে এদেশে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হয়। এ কারণেই যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
কৃষকের অতীত ইতিহাস : প্রাচীনকাল থেকে এদেশের কৃষকের অবস্থা ছিল সচ্ছল। গােলা ভরা ধান, গােয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ- এই [ ছিল বাংলার কৃষক পরিবারের চিত্র। তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিল কৃষক। কৃষিকে অবলম্বন করেই বাংলার মানুষ সুখে শান্তিতে জান কাটাতে পারত। কিন্তু বর্গীয় অত্যাচার, ফিরি পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শশাষণ ও _ নিপীড়নে কৃষক নিঃস্ব হয়ে যায়। সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলাে ভূমিহীন চাষিতে। কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :
স্কন্ধে যত তার চাপে ভার।
বহি চলে গতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার
তারপর সম্ভনেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি।
…শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোন মতে কষ্ট-ক্লিষ্টপ্রাণ।
রেখে দেয় বাঁচাইয়া। |
এভাবেই এককালের সুখী ও সমৃদ্ধ কৃষকের গৌরবময় জীবন-ইতিহাস অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
কৃষকের বর্তমান অবস্থা : বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক। পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি কৃষকের উদ্বাস্তু, অসহায় ও বিষন্ন জীবনের কোণে রূপান্তর ঘটেনি। বাংলার কৃষক আজও শিক্ষাহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন জীবনযাপন করছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ।। জমির উর্বরতাও গেছে কমে। ফলে বাড়তি মানুষের খাদ্য জোগানের শক্তি হারিয়েছে এদেশের কৃষক। পৃথিবীজুড়ে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নত দেশ কৃষকের শক্তি বৃদ্ধি। করছে। কিন্তু এদেশে এখনাে মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ ব্যবস্থা বহাল আছে। বাংলার কৃষকও ভোতা লাঙল আর কঙ্কালসার দুটো বলদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনাে কিছুই মােকাবিলা করার কৌশল ও সামর্থ্য কৃষকের নেই। তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত পদ্ধতি প্রয়ােগের গুরুত্ব বাড়ছে। সম্প্রতি ব্যাংক, সমবায় সমিতি বা মহাজনের ঋণের টাকায় আর উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে কৃষিতে ফলন বেড়েছে। কিন্তু ক্ষেতের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগেই ব্যাংক, সমবায় প্রতিষ্ঠান কিংবা মহাজনের ঋণ পরিশােধ করতে হয়। তাই কৃষকের সুখ-স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলেও কৃষকের | শশাচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না। এখনাে তারা নানা রােগ-শােক, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
সমস্যা নিরসনে করণীয় : কৃষকের এই অবর্ণনীয় দুরবস্থা দূর করতে হলে কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। এ বিষয়ে সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদের প্রযুক্তি কৃষকের জন্য সহজলভ্য করা প্রয়ােজন। সার, বীজ, কীটনাশক ও জ্বালানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব পণ্যের মূল্য যাতে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সেজন্য প্রয়ােজনে সরকারকে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সরকারকে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিদেশ থেকে অপ্রয়ােজনীয় কৃষিপণ্যের আমদানি বন্ধ করতে হবে। কৃষিনির্ভর শিল্প-কারখানা চালু করতে হবে। সুদের ব্যবসা বন্ধ করে কৃষকের জন্য সহজ শর্তে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। ভূমি সংস্কারের মধ্য দিয়ে কম আবাদি ও অনাবাদি জমির উর্বরতা বাড়াতে হবে। কৃষি সমবায় সমিতির মাধ্যমে ছােট ঘােট জমির যৌথ চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যবস্থা। কার্যকর করতে পারলে কৃষকের জীবনে সমৃদ্ধি নিয়ে আসা সম্ভব।
উপসংহার : কৃষকের উন্নতি ছাড়া দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতীয় স্বার্থেই কৃষকের দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি।। কৃষকের সমৃদ্ধিই জাতির সমৃদ্ধি। দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে কৃষকের উন্নতির জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে হবে।